শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:১০ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
আজকের আলোচনার বিষয় আপনার স্ত্রীর দেনমোহর কখন দিতে হবে না, আর কখন অর্ধেক দিলেও চলবে আবার কখন আপনি না দিয়েও মাফ পাইতে পারেন অথবা কোন কোন প্রেক্ষাপট সৃষ্টির কারণে স্ত্রী দেনমোহর পাবে না-এসব নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।
আমি আইনজীবী বিধায় অনেক বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন এবং অনেক ক্লাইয়েন্ট জিজ্ঞাসা করেন যে, দেনমোহর না দিয়ে কোনভাবে পার পাওয়া যায় কি-না অথবা কম দেওয়া যায় কিনা অথবা অর্ধেক দিলে চলবে কি-না আবার অনেকে জিজ্ঞাসা করেন দেনমোহর এখন বিবাহের কাবিননামায় কমানো যাবে কি-না ইত্যাদি নানা প্রশ্নবানে আমাকে জর্জরিত করে ফেলেন। তবে মনে রাখবেন মোহরানা স্ত্রীর সম্মানের প্রতীক। স্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শণ স্বরুপ স্বামীর উপর যে দায় আরোপিত হয়েছে সেটাই দেনমোহর। বিয়ে রেজিষ্ট্রি হোক বা না হোক স্ত্রী দেনমোহর পেতে অধিকারিণী। তবে অরেজিষ্ট্রিকৃত বিয়ে বিয়ের বৈধতা সম্পর্কে সন্দেহের সৃষ্টি করে। (ডাঃ আব্দুল বনাম রোকেয়া, ২১ ডিএলআর, ২১৩)
তবে দেনমোহর পাওয়া কিংবা না পাওয়া কিংবা অর্ধেক দেনমোহর পাওয়া এ সম্পর্কিত দুই একটা ব্যতিক্রম রয়েছে। আপনারা জানেন, দেনমোহরের প্রধান সোর্স বা উৎস হল পবিত্র কুরআন। সুরা নিসার ৪ নং আয়াতে স্পষ্ট বলা আছে যে, আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশীমনে। তারা যদি খুশী হয়ে তা থেকে অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর। কাজেই স্ত্রী ইচ্ছা করলে তার স্বামী বা স্বামীর ওয়ারেশগণের পক্ষে আংশিক বা সম্পূর্ণ দেনমোহর মওকুফ করে দিতে পারে। হতে পারে তা প্রতিদান ছাড়াই। এখানে কমানো বা মওকুফ অবশ্যই স্ত্রীর পূর্ণ সন্মতিতে হতে হবে। স্ত্রী তার স্বামীর মৃত্যুতে ভারাক্রান্ত হয়ে দেনমোহর মওকুফ বা কমাতে পারে, আবার ভালবাসা বা স্নেহ ইত্যাদি পাবার আশায় স্ত্রী দেন-মোহর পরিত্যাগ করতে পারে। তবে স্ত্রীর জন্য এগুলো বাধ্যতামূলক নয়। মনে রাখবেন নাবালক স্ত্রীর দেনমোহর মওকুফ অবৈধ। এখানে একটি বিষয় জেনে রাখা দরকার যে, মোহরানা যাই থাকুক না কেন স্বামী কিন্তু নিজ উদ্যোগে মোহরানা বৃদ্ধি করতে পারে। এতক্ষণ যে কথাগুলো বলছিলাম এ বিষয়ে ফায়ানী বেগম বনাম ওমরাভ বেগম, ৩২ ইন্ডিয়ান ল’ রিপোর্টস বম্বে সিরিজ, ১৯০৮, পৃষ্ঠা-৬১২ তে উল্লেখ রয়েছে।
এবার আসি, স্ত্রী কখন অর্ধেক দেনমোহর পাবে। যদি বৈধ বিবাহ হয় এবং দেনমোহর নির্ধারণ হয়ে থাকে কিন্তু স্ত্রীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক, সহবাস অর্থাৎ দাম্পত্য ভালবাসা পালন না হয় সেক্ষেত্রে স্ত্রীকে অর্ধেক দেনমোহর দিতে হবে। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনের সুরা আল-বাকারার ২৩৭ নং আয়াত বলছেন “আর যদি মোহর সাব্যস্ত করার পর স্পর্শ করার পূর্বে তালাক দিয়ে দাও, তাহলে যে মোহর সাব্যস্ত করা হয়েছে তার অর্ধেক দিয়ে দিতে হবে।
তবে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপন হয়নি বা হয়েছে-এরকম প্রশ্ন উত্থাপিত হলে হলে তা কিন্তু আইনগতভাবে প্রমাণ করতে হবে।
এবার আসি স্ত্রী কখন কোন দেনমোহর একেবারে নাই পেতে পারেন। যদি বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সহবাস অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই স্বামী স্ত্রীকে তালাক দেয় এবং এক্ষেত্রে যদি দেনমোহর বিবাহ অনুিিষ্ঠত হওয়ার সময় নির্ধারিত না হয়ে থাকে তাহলে স্ত্রী দেনমোহর পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।
এবার আসি আরেকটি পয়েন্টে। যদি বিয়েটি অনিয়মিত (irregular marriage) হয় এবং স্বামী স্ত্রীর মাধ্যে সহবাস অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই কোন পক্ষের মৃত্যু বা তালাক যেভাবেই বিয়েটির সমাপ্তি ঘটুক না কেন এবং এক্ষেত্রে যদি দেনমোহর নির্ধারিত হয়েও থাকে তোহলেও স্ত্রী কোন দেনমোহর পাবে না। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে অনিয়মিত বিয়েটা কি? যেমন, বিয়ের সময় সাক্ষীর উপস্থিতি না থাকা, চারটা স্ত্রী থাকা অবস্থায় পঞ্চম স্ত্রী গ্রহণ, ইদ্দত কালে বিয়ে ইত্যাদি।
মুসলিম আইনে নারীদের হাতে তালাকের তিনটি পথ খোলা আছে। ১. ‘খুল’ বা ‘খুলা’ তালাক, খ. মুবারাত এবং গ. আদালতের
মাধ্যমে বিচ্ছেদ। খুলা তালাকে স্বামী এবং স্ত্রী উভয়ের সম্মতির ভিত্তিতে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে থাকে। তবে উল্লেখ্য, এই ধরনের তালাকে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য স্ত্রী তার স্বামীকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে থাকে। সাধারণত ক্ষতিপূরণ হিসেবে স্ত্রী তার আর্থিক দাবির কোনো অংশ ত্যাগ করে এবং তখন স্বামী তালাক দেয়ার মাধ্যমে স্ত্রীকে বিবাহবন্ধন থেকে মুক্ত করে দেয়। কাজেই খোলা তালাক হচ্ছে স্বামীর দেনমোহর প্রদান থেকে অব্যহতি পাওয়ার একটি মোক্ষম হাতিয়ার। আর মুবারাত তালাক হলো পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বিবাহ বিচ্ছেদ। এ ধরনের বিবাহ বিচ্ছেদের বেলায় উভয়ই বিবাহ বিচ্ছেদে সম্মত হয় বলে কাউকে কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়া লাগে না। এক্ষেত্রেও স্বামী মোহরানা থেকে পরিত্রান পেতে পারে।
এবার ছোট্র একটি বিষয় অবতারণা করেই আমরা আলোচনার ইতি টানব। স্বামী স্ত্রীকে কোনো উপহার দিলে তা দেনমোহর বলে বিবেচিত হবে কি-না। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীকে অনেক কিছুই দিতে পারে। স্বামী যদি দেনমোহর হিসেবে স্ত্রীকে কিছু দেয়, তবেই তা দেনমোহর বলে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে “দেনমোহর বাবদ” কথাটি লেখা থাকতে হবে। যেমন: জমি হস্তান্তর দলিলে “দেনমোহর বাবদ” কথাটি লেখা না থাকলে এরূপ জমি-দেনমোহর হিসেবে ধরা হবে না। (আ: কাদের বনাম সালিমা, ১৮৮৬, ৮ ইন্ডিয়ান অল রিপোর্ট এলাহাবাদ সিরিজ, পৃষ্টা-১৪৯)।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, আইন গবেষক ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮